
১৯৬৮ সাল, চেকোস্লোভাকিয়া তখনও চেক রিপাবলিক ও স্লোভেনিয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। মানবিক সমাজতন্ত্র- এই স্লোগানকে সামনে রেখে সেবারের বসন্তে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানীতে জন্ম নিয়েছিলো প্রাগ বসন্ত, যার নায়ক ছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নেতা অ্যালেক্সান্ডার দুবচেক। তিনি ছিলেন জনগণের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এবং স্বাধীন মতামতপ্রকাশে বিশ্বাসী এক নেতা। মস্কোর অতি অনুগত বাম নেতারা নিজ জনগণ থেকে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলো, তা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এক সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, আর এর থেকেই প্রাগ বসন্তের সূচনা ঘটে।

অ্যালেক্সান্ডার দুবচেক; Image Source: Otago Daily Times
আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সোভিয়েত ব্লকভূক্ত দেশগুলোর সেনাবাহিনী চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রবেশ করে। তাদের কঠোর এই কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাগ বসন্তকে দমন করা হয়, যার প্রভাব আজও সে অঞ্চল থেকে যায়নি। দুবচেক চেক জনগণের উপর থেকে সরকারের যে কঠোর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা হ্রাস করেছিলেন, তা সোভিয়েতরা পুনরায় আরোপ করতে পারলেও এর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। শীতল যুদ্ধ চলার সময়ে সোভিয়েত এই আগ্রাসনকে মতপ্রকাশ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি মস্কোর অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশের উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। পশ্চিমা গণমাধ্যম এ সময় সমাজতন্ত্রকে এমন আদর্শ হিসেবে চিত্রিত করে, যাতে দেখানো হয় সমাজতন্ত্রকে কেবল বন্দুকের নল দিয়েই টিকে থাকতে হয়।

১৯৬৮ সালে সোভিয়েত আক্রমণের সময় চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগে একজন প্রতিবাদকারী; Image Source: Josef Koudelka/Magnum Photos
কিন্তু তার এই সংস্কারকে সোভিয়েত ব্লকভূক্ত দেশগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করলো না। মস্কোসহ অন্যান্য নেতারা ধারণা করলেন, দুবচেক বোধহয় চেকোস্লোভাকিয়ার উপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছেন। এমনকি তারা এটাও ধারণা করলেন যে, দুবচেক হয়তো ওয়ারশ চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মার্কিন পক্ষে যোগ দেবেন। এজন্য তারা দুবচেকের উদ্দেশ্যে কঠোর বার্তা প্রেরণ করলেন। তবে দুবচেক তা আমলে না নিয়ে তার সংস্কার কর্মসূচীর কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।

নিরস্ত্র নাগরিকরা সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল, চিৎকার করে বলছিল, "ফ্যাসিস্টরা ফিরে যাও!"; Image Source: PhotoQuest/Getty Images

১৯৬৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি প্রাগের Wenceslas Square এ একটি সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়; Image Source: Josef Koudelka/Magnum Photos
প্রাগ বসন্তের আগে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে দুটো বড় ধরনের আন্দোলন ইউরোপে হয়েছিলো, যার একটি হয়েছিল ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানিতে, আর অপরটি হয়েছিল ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে। উভয় আন্দোলনকেই মস্কোর সরাসরি হস্তক্ষেপে স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে শক্ত হাতে দমন করা হয়। সেই দুই আন্দোলনের সাথে ১৯৬৮ সালের প্রাগ গণজাগরণের একটা বড় পার্থক্য হলো, এ গণজাগরণ শুরুই হয়েছিলো স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে, যার মূল চেতনা আরও অধিকতর শুদ্ধ কমিউনিজম চর্চা। এ আন্দোলন কমিউনিস্ট শাসনের অবসান নয়, বরং কমিউনিস্ট শাসনের ধারাকে সংস্কারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিলো।

সাধারণ মানুষ পাবলিক বাস দিয়ে রেডিও ষ্টেশনের রাস্তা ঘিরে রাখে; Image Source: greenleft.org.au

সোভিয়েত সৈন্যরা চেকোস্লোভাকিয়া রেডিও বিল্ডিং দখল করতে চলেছে; Image Source: Josef Koudelka/Magnum Photos
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সোভিয়েত সৈন্য সমাবেশের কথা জানলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিনডন বি জনসন ধারণা করেননি, সোভিয়েত সেনারা সত্যি সত্যিই প্রাগের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থে কিছুই করার ক্ষমতা তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না। ১৯৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশেই বেকায়দা অবস্থায় ছিল। সে বছরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং সিভিল রাইট নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে হত্যা করা হয়। সেই সাথে চলছিলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ। নিজ দেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকা মার্কিন সরকার চেকোস্লোভাকিয়া প্রশ্নে বিবৃতি প্রদান ছাড়া পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অন্য কোনো বিবাদে জড়িয়ে পড়ার মতো বোকামি করার কথা চিন্তাও করেনি।
প্রাগ বসন্ত দমনের বহু বছর পর সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কারের জন্য যে 'পেরেস্ত্রোইকা' বা 'গ্লাসোনস্ত' আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা মূলত দুবচেকের মানবিক সমাজতন্ত্র কর্মসূচী দ্বারাই অনুপ্রাণিত।