আমাদের দেশে কেউ বয়সে উপনীত হলে কিংবা অসুস্থ হলে শিং মাছের ঝোল বা পুটি মাছের ঝোল রান্না করে খাওয়ানো হয়। মশলা মরিচ ছাড়া। যেমন তেমন তরকারি খেলে তাদের ক্ষতি হয়। পশ্চিমের দেশ কিংবা ইউরোপের দেশেও অসুস্থদের ঝোল খাওয়ানোর রীতি আছে। তবে তাদের ঝোল আমাদের শিং মাছ বা পুটি মাছের ঝোলের মতো নয়। তাদের সেই ঝোলকে বলে স্যুপ। মাছ, মুরগি কিংবা মাংস যেকোনো কিছু দিয়েই স্যুপ হতে পারে।
ইতালির বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানির স্ত্রী মাদাম গ্যালভানি একসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার অসুস্থতা নিয়ে একটি ঘটনা প্রচলিত আছে। কোনো ওষুধে, কোনো পথ্যেই তিনি সুস্থ হচ্ছেন না। অসহ্য ব্যথা। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। উপায় না দেখে তার ডাক্তার তাকে বিশেষ একটি স্যুপ খেতে বলেন। ব্যাঙের স্যুপ। এটিই সুস্থ হবার একমাত্র উপায়। কাশতে কাশতে বাড়ির পরিচারককে বললেন ব্যাঙের স্যুপ বানিয়ে দিতে। পরিচারক ব্যাঙ ধরে আনলো এবং স্যুপ বানাবার প্রস্তুতি নিল। মাদাম গ্যালভানি কষ্ট সহ্য করে অনেকটা জোর করেই বিছানা থেকে উঠলেন। স্যুপ বানানোর প্রক্রিয়া দেখবেন এবং বানানোতে তদারকি করবেন।
তিনি দেখেন, পরিচারক ব্যাঙয়ের চামড়া ছাড়িয়েছে, কিন্তু সেগুলোকে রাখার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছে না। তিনি বলে উঠলেন “এগুলোকে আমার স্বামীর ল্যাবের টেবিলের উপর রাখো।” পরিচারক নিয়ে গেল সেগুলো। যেখানে রাখলো তার পাশেই ছিল গ্যালভানির একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র। ছুরি হাতে নিয়ে সেগুলোকে কাটতে যাবে এমন সময় বিদ্যুতের একটি স্ফুলিঙ্গ এসে পড়ল ছুরিটির উপর। ছুরি হয়ে সেগুলো চলে গেল ব্যাঙয়ের গায়ের ভেতর। সাথে সাথেই ব্যাঙয়ের পা সজোরে নড়ে উঠলো এবং খিঁচুনির মতো কাপতে লাগলো। মাদাম গ্যালভানি দেখে একদম অবাক হয়ে গেলেন। স্বামীকে ডেকে বললেন “লুইজি দেখে যাও, অত্যন্ত মজার একটি ঘটনা এইমাত্র ঘটে গেল।”

নড়ে উঠল ব্যাঙয়ের পা; Image: The Writing Cooperative
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি নিজেই ছিলেন শারীরবিদ্যার অধ্যাপক। কাটা-ছেড়া করা তার দৈনন্দিন কাজ। ব্যাঙ ও বিদ্যুতের উপর তার নিজেরই আগ্রহ ছিল খুব। আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন জিনিসের উপর বিদ্যুৎ চালনা করে তার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতেন। ১৭৮০ সালের দিকে ইতালীয় এই বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন, মৃত ব্যাঙয়ের দেহে বিদ্যুৎ চালনা করলে সেটির হাত-পা নড়াচড়া করে।
তবে ব্যাঙয়ের স্যুপের ঘটনা দিয়ে না হলেও অন্যভাবে মাদাম গ্যালভানি ঠিকই সাহায্য করেছেন লুইজি গ্যালভানিকে। লুইজি নিজেও তার স্ত্রীর অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। তার স্ত্রীও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানী পরিবারের সন্তান। তিনি ব্যাঙয়ের স্যুপ খেয়ে থাকেন আর না থাকেন, এটি তাকে সাহায্য করেছে বলে মনে হয় না। কারণ ১৭৯০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

লুইজি গ্যালভানি; Image Source: Wikimedia Commons
এখানে আরো একটি সম্ভাবনা উঁকি দেয়। যেহেতু এরকম কাজ একদমই নতুন এবং সাধারণ মানুষও এই বিষয়ে আগ্রহী, তাই এটাকে ব্যবহার করে স্টেজ পারফরমেন্স করা যায়। লোকে টিকেট কেটে আসবে মৃতদেহের উপর বিদ্যুৎ চালনা করলে কী ঘটে তা দেখার জন্য। এদিকে গ্যালভানি ছিলেন লাজুক স্বভাবের। মানুষের সামনে এসব কাজ করতে চাইতেন না। তবে তার এক ভাতিজা ছিল। নাম জিওভান্নি অলডিনি। তিনি এই বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মৃতদেহে বিদ্যুৎ চালনার চর্চাকে অন্য উচ্চতায় উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার চাচা গ্যালভানির পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোকে সর্বসাধারণকে দেখার ব্যবস্থা করে দেন। সারা ইউরোপ ঘুরে ঘুরে এই কাজ করতে থাকেন। মৃত মানবদেহে বিদ্যুতায়ন- গা গুলিয়ে আসা এই পরীক্ষা দেখতে দলে দলে ভিড় করতে থাকে মানুষ।

মৃতদেহের উপর বিদ্যুতের পরীক্ষা দেখতে ভিড় করতে থাকে মানুষ; Image Source: Atlas Obscura
প্রথমেই মুখের অংশটি। মুখে এবং কানে তার সংযুক্ত করা হল। বিদ্যুৎ চালনা করার সাথে সাথে চোয়ালের পেশী কাঁপতে শুরু করল। মুখ হা হয়ে গেল। সেখানে ফুটে উঠল তীব্র যন্ত্রণার ছায়া। খুলে গেল বাম চোখ, যেন তার শাস্তিদাতাকে স্থির দৃষ্টিতে দেখছে। এভাবে অন্যান্য অঙ্গের মাঝেও চলতে থাকলো পরীক্ষা। পাপেট পুতুল যেমন কাঠি ও সুতা দিয়ে নাড়ানো হয়, তেমনই যেন মৃতদেহকে বিদ্যুৎ ও তারের মাধ্যমে নাড়িয়ে চলেছে অলডিনি। পিঠকে বাকিয়ে খিলানের মতো করলেন, হাত দিয়ে টেবিলকে আঘাত করালেন, ফুসফুস দিয়ে নিঃশ্বাস গ্রহণ করালেন, নিঃশ্বাস ত্যাগও করালেন। আরো কত কী! সবার শেষে একটি তার দিলেন কানের মাঝে এবং আরেকটি তার দিলেন পায়ুপথে। খুনের অপরাধী ফর্স্টারের দেহ ভয়ংকরভাবে লাফিয়ে উঠে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। স্থানীয় পত্রিকা দ্য লন্ডন টাইমস ঘটনাটির বর্ণনা দিচ্ছে এভাবে-
ডান হাতটি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায় এবং ঊর্ধ্বে লাফিয়ে উঠে। উরু আর পা দুটি যেন সচল হয়ে যায়। কয়েকজন নিরীক্ষক ঘটনাটি মনোযোগের সাথে দেখছিলেন। সত্য মিথ্যা যাচাই চলছে। তাদের কাছে মনে হয়েছিল এই হতভাগা লোকটি যেন তার নতুন জীবন পাবার দীর্ঘ কষ্টকর এক পর্যায়ে আছে।
কিছুদিন পর তিনি তার এই পরীক্ষা নিয়ে যান লন্ডনের আরেকটি স্থানে। সেখানে একটি ষাঁড়ের কাটা মাথা এনে রাখা হয়। একটি হুক লাগিয়ে এর ভেতর থেকে জিহ্বাটিকে টেনে বাইরের দিকে আনা হয়। আংটা দিয়ে কোনো এক স্থানে লাগিয়ে জিহ্বাটিকে সেভাবেই রাখা হয়। তারপর সেখানে বিদ্যুৎ চালনা করতেই জিহ্বাটি নড়াচড়া করতে থাকে এবং প্রবল শক্তিতে ভেতরের দিকে যাবার চেষ্টা করে। এত দ্রুত বেগে কাঁপতে থাকে যে এটি আংটা লাগানো হুক থেকে ছুটে যায়। সে সময় একটি তীব্র শব্দ বের হতে থাকে মুখ থেকে। যেন মনে হচ্ছিল প্রয়োগ করা বিদ্যুৎগুলো মুখ দিয়ে বের হচ্ছে।
আরো অভাবনীয় ব্যাপার ঘটে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে। ১৮১৮ সালের ৪ নভেম্বরে। রসায়নবিদ এন্ড্রু ইউরি ২৭০ প্লেটের বিশাল ব্যাটারি দিয়ে মৃতদেহের উপর পরীক্ষা চালান। এর আগে জিওভান্নির পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছিল ১২০ প্লেট কপার-জিংকের ব্যাটারি। এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে দ্বিগুণ। দ্বিগুণেরও বেশি। দ্বিগুণ শক্তি, দ্বিগুণ আনন্দ, দ্বিগুণ উন্মাদনা। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি ম্যাথিও ক্লাইডেসডেলের মৃতদেহ লাগানো হলো ব্যাটারির শক্তিশালী বিদ্যুতের তার। মেরুদণ্ডের অস্থিমজ্জা আর নিতম্বের স্নায়ুর মাঝে দেওয়া হলো সংযোগ। এরপর-
সাথে সাথেই শরীরের প্রত্যেকটি পেশি খিঁচুনির মতো করে উত্তেজিত হয়ে উঠে। প্রচণ্ড শীতে কাউকে শীতল পানিতে নামিয়ে দিলে যেমন ঠোটে মুখে কাঁপন ধরে যায় তেমন করে কাঁপতে থাকে এটি। খুব দ্রুত লয়ে। বুক ফুলছে এবং নামছে। খুব কষ্ট করে শ্বাস নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পেট একবার প্রসারিত হচ্ছে পরমুহূর্তে সংকুচিত হচ্ছে।

শিল্পীর কল্পনায় ইউরির মৃতদেহের পরীক্ষা; Image Source: The Times
অলডিনি এবং ইউরির মতো ব্যক্তিরা বিশ্বাস করত এই বিদ্যুৎ দিয়ে মৃতদেহের উপর স্টেজ শোয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু করা সম্ভব। তারা শুধু উপযুক্ত উপায়টা পাচ্ছে না, যার কারণে সেগুলো করে দেখাতে পারছে না। তবে একসময় আসবে যখন সেসব অসম্ভব বিষয় বাস্তবে পরিণত হবে। তাদের জোর বিশ্বাস ছিল উপযুক্ত পরিবেশে উপযুক্তভাবে বিদ্যুৎ প্রয়োগ করতে পারলে মৃতদের জীবন ফিরিয়ে আনা যাবে। খুনি ক্লাইডেসডেলের দেহ নিয়ে পরীক্ষা করার সময় ইউরি লিখেন-
এখানে জীবন ফিরে আসার একটা দারুণ সম্ভাবনা আছে। এরকম পরীক্ষা অল্প কিছু মানুষের বেলায় অনুমোদন আছে। শুধুমাত্র মৃত্যুর সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের নিয়ে এটি করা যায়। যদিও ব্যাপারটি আইনবিরোধী, কিন্তু তারপরেও এটি মার্জনীয়। কারণ প্রাণ ফিরিয়ে আনা নিঃসন্দেহে মহৎ ব্যাপার। আর তাছাড়া বিজ্ঞানে এরকম পরীক্ষার গুরুত্বও অনেক।

এন্ড্রু ইউরি; Image Source: Drenmstime
বিশ্বের প্রথম কল্পবিজ্ঞান এবং অন্যতম সেরা হরর উপন্যাস ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’-এর কথা কে না শুনেছে? কালজয়ী এই বইয়ের লেখক মেরি শেলি। মৃতদেহের উপর বিদ্যুতের পরীক্ষা নিরীক্ষা দেখেই তিনি এটি লিখতে উৎসাহিত হন। বইটির ১৮৩১ সালের সংস্করণে তিনি লিখেন যে, ১৮১৬ সালের জুনে এই বইটির আইডিয়া তার মাথায় আসে। সে সময় তার স্বামী পার্সি শেলি ও কবি লর্ড বায়রন মৃতদেহের উপর বিদ্যুতের পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সে আলোচনা শুনে তিনি ভেতরে খুবই আলোড়িত হন। কোনোভাবে কি মরে যাওয়া দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনা যাবে? উল্লেখ্য, তার শিশু সন্তান মারা গিয়েছিল কিছুদিন আগে। সন্তানটি নিয়ে প্রবল শূন্যতায় ছিলেন তিনি। সন্তানকে ফিরে পাবার অবচেতন ইচ্ছে থেকেই লিখে ফেললেন ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ নামের উপন্যাসটি। এখানে বিদ্যুৎ চালনার মাধ্যমে তার দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনা হয়।

মেরি শেলি ও ফ্রাংকেনস্টাইন বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: hollywoodreporter.com
তথ্যসূত্র
Alex Boese, Elephants on Acid: And Other Bizarre Experiments, Electronic Edition, Published on 2010 by Pan Books
How Twitching Frog Legs Helped Inspire ‘Frankenstein’, Smithsonian Magazine
The Real Electric Frankenstein Experiments of the 1800s, Atlas Obscura
The Experiment That Shocked the World, Helix Magazine
আবিষ্কারের নেশায়, আব্দুল্লাহ আল মুতী, অনুপম প্রকাশনী