
মারভেলের কল্যাণে থর, লোকি আমাদের কাছে খুব পরিচিত নাম। ১৯৬২ সালে স্ট্যান লি যখন নর্স উপকথার বজ্রদেবতা থরকে নিয়ে নতুন কমিক সিরিজ শুরু করেছিলেন, তখন হিরো ডক্টর ডোনাল্ড ব্লেইক ছিলেন আর সব সুপারহিরোর মতোই সাধারণ একজন মানুষ, যিনি ঘটনাক্রমে পেয়ে গেছেন বজ্রদেবতার দৈবক্ষমতা। কিন্তু পরবর্তী সিরিজগুলোতে উঠে আসতে শুরু করে থরের মূল পরিচয়, ব্লেইক হয়ে যায় ক্লার্ক কেন্টের মতো একটি ভুয়াচরিত্র, আর ভক্তসমাজ পরিচিত হয় নর্ডিক মিথোলজির সাথে। কিন্তু কাহিনীর প্রয়োজনে স্ট্যান লি এবং জ্যাক কারবি যেমন বদলে দিয়েছেন অনেক তথ্য, তেমনি যোগ করেছেন নতুন কিছুও। ফলে মারভেলের থর হয়ে উঠেছে অসাধারণ ফিকশন, কিন্তু একইসাথে চলে গেছে আদি মূলধারার নর্ডিক উপকথা থেকে অনেক অনেক দূরে।
শুরু করা যাক কেন্দ্রীয় চরিত্র থরকে দিয়েই। মারভেলের থর সোনালী চুলের সুঠামদেহী, সুদর্শন হিরো। তার মুখে দাঁড়ি-গোঁফ বিশেষ দেখা যায় না। মুভিতে ক্রিস হেমসওয়ার্থের অভিনয় এই ধারণা আরও পাকাপোক্ত করে। থরকে সবসময় শেক্সপিয়ার আমলের ইংরেজি (thee, thy ইত্যাদি) ব্যবহার করতে দেখা যায়। অথচ উপকথার থরের মূল আদি নর্সরা কোনো ধরনের ইংরেজি ব্যবহার করতো না। থরকে বর্ণনা করা হয়েছে লাল চুলের এবং মুখে দাঁড়ি গোঁফে ভরা এক ব্যক্তি হিসেবে। নর্সদের কাছে দাঁড়ি হচ্ছে পুরুষত্ব আর বীরত্বের প্রতীক। কাজেই যোদ্ধা দেবতা থরের ক্লিন শেভ করার প্রশ্নই আসে না!

উপকথার থর বনাম মারভেল থর; Image Source: ifanboy

ওডিন; Image Source: Ancient Pages
অপরপক্ষে উপকথার ওডিন একজন যোদ্ধা দেবতা। ওডিন সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও যেকোনো যুদ্ধ শুরুর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেন। উপকথার ওডিন জ্ঞানপিপাসু, রহস্যময়, যিনি জাদুবিদ্যার চর্চা করেন। তিনি খামখেয়ালী এবং নিষ্ঠুর। সর্বজ্ঞানী মিমিরের কাছে একটি চোখের বিনিময়ে ওডিন জ্ঞান ও জাদুবিদ্যা অর্জন করেন। ওডিনকে প্রায়ই জায়ান্টদের সাথে জ্ঞান ও ভবিষ্যতবাণী নিয়ে বিতর্কে রত হতে দেখা যায়। তার সবসময়ের সঙ্গী দুটি কাক হাগিন ও মুনিন বা চিন্তা ও স্মৃতি। ওডিন ও তার স্ত্রী ফিগের ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা থাকলেও তা পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই।

অপকর্মের দেবতা লোকী; Image Source: Pinterest
উপকথার লোকি মূলত একজন তামাশাপ্রিয় দেবতা, যে শুধুমাত্র মজা করার জন্য অন্য দেবতাদের অদ্ভুত বিপদে ফেলত। তাকে অনেক সময় দেবতাদের সাহায্য করতেও দেখা যায়, যদিও তা তার নিজেরই কোনো কৃতকর্মের খেসারত হিসেবে। লোকি এমন এক দেবতা যে বিশৃংখলা ভালোবাসে। কমিক এবং মুভিতে নরকের রানী হেলাকে ওডিনকন্যা হিসেবে দেখানো হলেও উপকথায় হেলা লোকির সন্তান। মারভেল হেলাকে ভিলেন হিসেবে দেখালেও উপকথার হেলা নিরপেক্ষ এবং মৃতদের রক্ষক।

থরের অর্ধাঙ্গিনী সিফ; Image Source: Pinterest
মুভিতে থরের স্ত্রী সিফের যুদ্ধংদেহী মূর্তি অনেকের মন জয় করে নিয়েছে। কালো চুলের দক্ষ যোদ্ধা সিফ যেন থরের যোগ্য জীবনসংগী। তবে নর্স উপকথার সিফের বর্ণনা যে এই সিফের সাথে একেবারেই মেলে না! পৃথিবীর দেবী সিফ যে কেবল নারীসুলভ তা-ই নয়, তিনি কোনোদিন অস্ত্র স্পর্শ করেও দেখেননি। তাঁর মাথায় দীর্ঘ সোনালী চুল আছে, যা তার অহংকার। একবার লোকি চাতুরি করে সিফের চুল কেটে ফেলায় সিফ এত কান্না করেন, থর লোকিকে মারতে মারতে বাধ্য করেন বামনদের দিয়ে সিফের জন্য সোনার চুল গড়িয়ে আনতে। মুভির সিফের সাথে মেলাতে পারছেন না তো? খুব স্বাভাবিক।

মারভেল বদলে দিয়েছে বল্ডার আর হেইমডালের মতো হিরোদের; Image Source: Pinterest
মারভেলের হিরো বল্ডার আসলে থরের শান্ত, নমনীয় আর সকলের প্রিয়। নর্স উপকথায় বল্ডারও সকলেরই প্রিয় ছিল, লোকি ছাড়া। লোকি বল্ডারকে হত্যা করায় তার অন্ধ ভাই হডের মাধ্যমে। মারভেল ইউনিভার্সে বল্ডারকে পুনরুজ্জীবীত করা হলেও নর্স উপকথায় বল্ডারকে থেকে যেতে হয়েছিল হেলার শীতল রাজ্যে। উপকথার হেইমডালও দেবতাদের রাজ্য অ্যাজগার্ডের পাহারাদার, কিন্তু তার দৃষ্টি ওডিনের মতো প্রখর নয়। অন্যান্য যুদ্ধদেবতাদেরও র্যাগনারকে তেমন অংশ নিতে দেখা যায় না, যেখানে উপকথায় তাদের প্রত্যেকের ভাগ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

অনেক দেবতা বাদ পড়লেও কমিকে আনা হয়েছে নতুন চরিত্র; Image Source: Marvel

ভুল বোঝা হলো জায়ান্টদেরও; Image Source: Orcses
কমিক এবং মুভিতে ফ্রস্ট জায়ান্টদের দেখানো হয়েছে বর্বর, জানোয়ারসুলভ দানব হিসেবে। উপকথার জায়ান্টরা তাদের পিতা ইয়েমিরের পা থেকে জন্মলাভ করে এবং প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকে বিধায় এরা মূলত প্রকৃতির দেবতাদের মতোই। দেবতা এবং জায়ান্টদের প্রায়শই প্রণয় ও পরিণয়ে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। জায়ান্টরা কেবল যোদ্ধাই নয়, তারা জ্ঞানী এবং কবি। ওডিন জায়ান্টদের কাছে থেকে জ্ঞান আহরণ করেন এবং কাব্যপ্রতিভা চুরি করেন। মারভেল ইউনিভার্সের কল্যাণে জায়ান্টদের সাথে বিরাট এক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেল।

ভুল রয়েছে রাগনারকের ধারণাতেও; Image Source: Devianart
\থর ফ্র্যাঞ্চাইজে রাগনারক কয়েকবার আসলেও সিরিজের পুনর্বহালের জন্য কখনই এতে পৃথিবীর শেষ দেখানো হয় না। মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সে রাগনারক তাই দেবতা আর জায়ান্টদের যুদ্ধ। নর্স উপকথার রাগনারক মানেই সবকিছুর শেষ, ধ্বংস। রাগনারকের দিন নেকড়েরা গিলে ফেলবে চাঁদ আর সূর্য, ফেনরির উলফ গিলে ফেলবে ওডিনকে, থর মারা যাবে মিডগার্ডের সরিসৃপ জরমুনগাডের সাথে লড়াইয়ে, ফায়ার জায়ান্ট সার্ট আগুন ধরিয়ে দেবে বিশ্ববৃক্ষে, পুড়ে যাবে সব জগত। শুধু বেঁচে থাকবে থরের দুই ছেলে মাগনি-মোদি আর কিছু মানুষ, যারা পুনরায় শুরু করবে সভ্যতা। নর্স উপকথার রাগনারকের তুলনায় মারভেলের রাগনারক যেন নিতান্তই ছেলেখেলা।
মারভেল ইউনিভার্সের মতো নর্ডিক মিথোলজিও বিশৃংখলায় পরিপূর্ণ। তবে একটি শিক্ষা সর্বজনীন, 'ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন'। যা ভাগ্যে আছে, যা অনিবার্য, তা ঘটবেই। কোনো শক্তি দিয়েই একে থামানো যাবে না, পরিবর্তন করা যাবে না। তাই নর্ডিক উপকথার দেবতারা অবশ্যম্ভাবী জেনেও অপেক্ষা করে যায় রাগনারকের।