
১৫ আগস্ট, ১৯৪৫। নাগাসাকির উপর ভয়াবহ ফ্যাটম্যান আঘাত হানার পর কেটে গেছে আরো এক সপ্তাহ। সম্রাট হিরোহিতো এয়ারওয়েভের মাইক্রোফোন তুলে নিলেন।
“শত্রুরা একধরনের নতুন বোমা তৈরি করা শুরু করেছে, যার ক্ষতিসাধনের পরিমাপ করা এককথায় অসম্ভব, প্রচুর সাধারণ এবং নিরীহ জনগণের জীবন মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি এই যুদ্ধ চালিয়ে যাই, তাহলে শুধু জাপানীরাই বিলীন হয়ে যাবে না, বরং মানবসভ্যতাই হুমকির মুখে পড়তে পারে।”
এবং এভাবেই জাপান আত্মসমর্পণ করলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর চার বছরে ৩১ লক্ষ জাপানী সৈন্য কিংবা সাধারণ জনগণ মারা গিয়েছে, আহত এবং পঙ্গু হয়েছে আরো কয়েক লক্ষ মানুষ, ধসে পড়েছে জাপানের অর্থনীতি, মজুদ করে রাখা সম্পদ তলানিতে ঠেকেছে, কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে রয়েছে। মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারকে পাঠানো হলো মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে যেন জাপানীরা আবারো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে গড়ে উঠতে না পারে। জাপানের সামরিক শক্তি কমিয়ে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো, একইসাথে গণতন্ত্রবাদীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলো। কিন্তু জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোনো ধরনের সাহায্য করতে তারা অস্বীকৃতি জানালো। তো কীভাবে জাপান আণবিক বোমার আঘাতে ছাই হয়ে যাওয়া একটি রাষ্ট্র থেকে ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জাগরন ঘটালো? কীভাবেই বা তারা শক্তিশালী শিল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠলো?

টোকিওর উপর বিধ্বংসী বোমা হামলায় জনসংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিলো; Image Source: keepo.me
১৬৩৩ সালে তৎকালীন সময়ের তোকুগাওয়া শাসকগোষ্ঠী জাপানকে পুরো বিশ্ব থেকে আলাদা করে একপ্রকার নির্বাসিত করেই রেখেছিলো, ক্রমাগত বড় হওয়া আগ্রাসী ইউরোপীয় উপনিবেশ হওয়া থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে। চীন, কোরিয়া আর নেদারল্যান্ডসের সাথে খুবই সীমিত মাত্রার নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের বৈদেশিক বাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। বিদেশে যাওয়াও নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো জাপানীদের জন্য, একইসাথে সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে এমন ধরনের জাহাজও তৈরি বন্ধ করে দেওয়া হলো। কিন্তু ১৮৫৩ সালে হঠাৎ করেই সবকিছুর পরিবর্তন ঘটলো, যখন টোকিও বে-তে হাজির হলো চারটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ, দাবি করলো এখানে মার্কিনীদের বাণিজ্যের অনুমতি দিতে হবে। মার্কিনীদের উন্নত যুদ্ধাস্ত্র এবং গোলাবারুদ দেখে অবশেষে জাপানী বন্দর উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো আর শুরু হলো পশ্চিমাকরণ। শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া পৌঁছে গেল জাপানে।
নতুন যুগে প্রবেশ করলো জাপান। সর্বসাধারণের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে গেল, শিল্পখাতে শুরু হলো অভূতপূর্ব উন্নয়ন। উদ্যোক্তাদের কাছে জাপান সরকার কারখানা ও শিপইয়ার্ডগুলো নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিলো। নতুন বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করা হলো, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশাল ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হলো। পোশাকশিল্পে ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলো জাপান, ভারত এবং চীনে ব্রিটিশ পণ্যগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেদের বাজার তৈরি করে নিলো। বিংশ শতাব্দীর মধ্যেই জাপান হয়ে উঠলো বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম পরাশক্তি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী জাপান (১৯২৫); Image Source: Wikimedia Commons
কিন্তু এই পাহাড়ের মতো ঊর্ধ্বগতিতে এগিয়ে চলা অর্থনীতি জাপানীদের মনে অহংকারের বোঝা ঢুকিয়ে দিলো। ক্রমেই সাম্রাজ্য বিস্তার করা জাপানীরা মার্কিনীদের অবমূল্যায়ন করেছিল, এবং মার্কিনীরা কত দ্রুত পার্ল হারবারের জবাব দেবে তা মোটেই আন্দাজ করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শিল্পকারখানাগুলোকে সামরিক কারখানায় রুপান্তরিত করা হলো। মিত্রবাহিনীর বি-২৯ বোম্বারের উপর্যুপরি আক্রমণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো জাপানের কারখানাগুলো, অবকাঠামোও ধসে পড়লো। বন্ধ হয়ে যাওয়া উৎপাদন আর বাধাহীন মুদ্রাস্ফীতি জাপানের অর্থনীতিকে একপ্রকার থামিয়ে দিলো।

যুক্তরাষ্ট্র পার্ল হারবারের জবাব দিয়েছিলো আরো নির্দয়ভাবে; Image Source: Pearl Harbor Tours
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ৩ বছরে ম্যাকআর্থার কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম জাপানের অবস্থা আরো খারাপ করে তুললো। কারখানাগুলো ধসিয়ে দেওয়া হলো, এর যন্ত্রপাতিগুলোকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রে। ‘জাইবাতসু’ ব্যবস্থা- জাপান সাম্রাজ্যের শিল্পকারখানাগুলোর পারিবারিক উত্তরাধিকারী হিসেবে পাওয়া সম্পদ, সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হলো। অর্থাৎ, ছেলে তার বাবার রেখে যাওয়া শিল্পকারাখানাগুলোর একচ্ছত্র মালিক হতে পারবে না। কারণ আমেরিকানদের মতে, এ ধরনের ব্যবস্থা শুধু দুর্নীতি কিংবা অদক্ষতার কারণই নয়, বরং অগণতান্ত্রিকও বটে।
যা-ই হোক, শীঘ্রই জাপানের অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো। তাদের উপরে থাকা বিভিন্ন শর্ত উঠিয়ে নেওয়া হলো। যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ায় মার্কিনীরা আশঙ্কা করেছিলো গরীব অর্থনীতির জাপান সমাজতান্ত্রিক দলে ভিড়তে পারে। জাইবাতসু ব্যবস্থা পুনরায় বহাল করা হলো, জাপানকে অর্থনৈতিক সহায়তা হিসেবে ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করা হলো। কয়লা, স্টিল, বিদ্যুৎ উৎপাদন আর রাসায়নিক শিল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগ করা হলো।
কারখানাগুলো পুনরায় তৈরি করা হলো এবং তাতে যুক্ত করা হলো আরো আধুনিক এবং উন্নতমানের যন্ত্রাংশ। জাপানের শিল্পকারখানাগুলো হয়ে উঠলো তৎকালীন সময়ের অন্যতম আধুনিক কারখানায়, এমনকি মিত্রশক্তি দেশগুলোর তুলনায়ও! ১৯৪৬ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন শিগেরু ইয়োশিদা, এবং তার প্রবর্তিত ইয়োশিদা ডকট্রিনের নীতি অনুযায়ী, জাপানের উচিৎ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করা এবং অর্থনীতির উপর জোর দেওয়া।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইয়োশিদার সাথে মার্কিন কমান্ডার আর্থার র্যাডফোর্ড; Image Source: The Japan Times
এমন সময়ই কোরিয়া যুদ্ধ শুরু হলো এবং অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো। যুক্তরাষ্ট্রের তখন সামরিক ঘাঁটি তৈরি করার জন্য জায়গা প্রয়োজন, এবং জাপানের মতো নিখুঁত জায়গা আর কী হতে পারে? সামরিক ঘাঁটি তৈরি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদায় শিল্পকারখানাগুলো আবার রূপ নিলো সামরিক কারখানায়। সামরিক অস্ত্র আর যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে জাপানের অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হয়ে উঠলো। ইয়োশিদার মতে, কোরিয়া যুদ্ধ জাপানের জন্য ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছিল।
কোরিয়া যুদ্ধ ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে জাপানে নিয়ে আসলো ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! যুদ্ধের প্রথম ৮ মাসে স্টিল উৎপাদন বেড়ে গেল ৩৮%, একইসাথে অটোমোবাইল শিল্পেরও আবার পুনর্জাগরণ হলো। টয়োটার বিক্রি বেড়ে গেল প্রায় ৪০ শতাংশ!

শিল্পকারখানাগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন হলো পঞ্চাশের দশকে; Image Source: The Atlantic
ষাটের দশকে নেওয়া ইকেদার বিখ্যাত ‘আয় দ্বিগুণ পরিকল্পনা’র মাধ্যমে দশ বছরের মধ্যে জাপানের সাধারণ জনগণের আয় দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করা হলো, এবং তা বাস্তবায়িত হয়েছিল সময় শেষ হওয়ার অনেক আগেই। ষাটের দশকের পুরোটা ধরেই বাসাবাড়ির সাধারণ জিনিসপত্র, যেমন- রেফ্রিজারেটর কিংবা সেলাই মেশিন আরো সহজলভ্য হলো, যেমনটা হলো রেডিও, ক্যামেরা, টিভি কিংবা এয়ার কন্ডিশনারের মতো বিলাসদ্রব্য। খাবার এবং কাপড়চোপড়ের চাহিদা কমার পরিবর্তে বিনোদন কিংবা অন্যান্য জিনিস, যেমন: আসবাবপত্র, বই, যোগাযোগ আর যাতায়াত ব্যবস্থার চাহিদা বেড়ে গেল। ইকেদা সরকার তখন জাপানের অবকাঠামোর দিকে নজর দিলো, প্রচুর পরিমাণে হাইওয়ে, রেলওয়ে, সাবওয়ে, এয়ারপোর্ট, বন্দর আর বাঁধ গড়ে তোলা হলো। আর এই দশক পরিচয় পেলো ‘সোনালী যুগ’ হিসেবে।
১৯৬২ সালের মধ্যেই টোকিওর জনসংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে গেল, হয়ে উঠলো পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর। দুই বছর পরেই অলিম্পিক আয়োজনের জন্য টোকিও শহরকে আবারো ঢেলে সাজানো শুরু হলো। অলিম্পিক সরাসরি সম্প্রচারের জন্য তৈরি করা হলো নতুন স্যাটেলাইট টাওয়ার। ট্রান্সপ্যাক-১, প্রশান্ত মহাসাগরের এ'মাথা থেকে ও'মাথা যোগাযোগের জন্য জাপান থেকে হাওয়াই পর্যন্ত কেবল সংযোগ করা হলো। বুলেট ট্রেনের বদৌলতে জাপানের রেলওয়ে হয়ে উঠলো পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত রেলওয়ে যোগাযোগ মাধ্যম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগেই শেষ করে ফেলা হলো টোকিওর প্যাঁচানো রাস্তার নিচে থাকা সাবওয়ের কাজ। অলিম্পিকের জন্যই জাপান বিশ্বের কাছে পরিচিত হলো নতুনভাবে, যুদ্ধের শত্রু হিসেবে নয়, বরং শান্তি ও সমৃদ্ধিতে বিশ্বাসী এক জাতি হিসেবে।

পৃথিবীর প্রথম বুলেট ট্রেন; Image Source: japantimes.co.jp
১৯৮০ সালের মধ্যেই জাপানের বেকারত্বের হার নেমে এলো ৫%-এর নিচে, এবং আশির দশকের পুরোটা ধরেই এর লেখচিত্র ছিল নিম্নমুখী। জাপানের রেস্তোরাঁগুলোতে ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার ডলার খরচ করতে থাকলো, গুচ্চি, আরমানি আর লুই ভ্যুটোনের মতো বিলাসী পোশাকদ্রব্যের দোকানগুলোতে দেখা গেল জাপানীদের ভিড়। জাপানী পর্যটকদের সংখ্যাও বেড়ে গেল যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
জাপানীদের বিনোদন জগত দখল করে নিলো অ্যানিমে আর মাঙ্গা। জাপানে তৈরি হলো সুপার মারিও আর ডংকি কংয়ের মতো চরিত্র, অ্যাস্ট্রো বয় আর আকিরার মতো ক্লাসিক অ্যানিমেগুলোর জন্ম হলো একইসময়ে। নিন্টেন্ডোর হাত ধরে সূচনা হলো ভিডিও আর্কেড গেমসের।

আর্কেড গেমসের সূচনা হয়েছিল জাপানেই; Image Source: imdb.com
যা-ই হোক, এই দ্বীপ রাষ্ট্র এখনো বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে। জাপানী পপ মিউজিক, অ্যানিমে কিংবা কারাতে দিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বের কাছে।